ও কবি ও লেখক!
লেখক
মো. জিয়াউদ্দিন শাহ্
আপডেট: ০২ মে ২০১৮, ১৬: ০৮
ক্রমাগত শেখার ইচ্ছা ও জ্ঞান অর্জনের পিপাসা প্রায় আমাকে নির্ঘুম রাত উপহার দেয়। না জানার আকুতি, ধৈর্যহীন চাওয়া পাওয়া ও বিবেকহীন বাসনা জীবনকে দেয় না কোনো আশার বাণী। ধৈর্যহীন ব্যক্তি, জাতি ও জাতিগত মানুষেরা ধৈর্য-নিষ্ঠার কিছুই লাভ করতে পারেন না। পবিত্র কোরাআন শরিফে চার শ বার ধৈর্য (সবর) শব্দটি বর্ণিত হয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ধৈর্যের গুরুত্ব অপরিহার্য। দুর্লভ কিছু লেখাতেও জীবনে হয়ে ওঠে অপরিহার্য। যা হওয়ার বাসনাই আমাকে লেখক হতে দেন না। অন্যদিকে আত্মোপলব্ধির পুরো দস্তুর রায়ে নিজেকে লেখক দাবিতে ভীষণ অনীহা আছে।
জীবন চলছেই, বিশেষ কেউ হতে পারা না পারায় তা থেমে থাকে না। ক্ষীণজীবী হয়েও তা অবাধ চাওয়া পাওয়া জন্ম দেয়! কখনো নিজেকে ফেলে আত্মসমালোচনায়। নির্বাক প্রশ্ন তুলে বলে, সবকিছুই আমার মতো হতে হবে কেন? লোভ-লালসা বিসর্জনে পিছিয়ে আছি কেন? নেওয়ার চেয়ে দেওয়া মুখ্য নয় কেন? কী নিলাম আর কী দিলাম? কী করে বেড়ালাম? জীবন কী ভবঘুরে? সত্যের অনুসন্ধান করলাম কী? জীবনের পরিণতিই বা হবে কী? যদিও তুষ্টতা শ্রেয়। শ্রেয়হীনতাই জীবনের অসুখ। এটা অনেক বড় অসুখের চেয়েও বিশেষ বড় অসুখ। এখানে অন্যকে জড়ানোর অধিকার না থাকলেও দু-চার কথা জড়িয়ে যায়। জীবন জীবনকে প্রাণবন্ত করে। হতে পারে সাদৃশতা (similarity) গুণের অংশ। বিশেষ গুণে যাঁরা স্মরণীয় হয়ে গেছেন তাঁরা চির বিত্তবান্, জগৎবাসী কল্যাণে রেখে গেছেন সত্যের নিদর্শন। আমরা স্বার্থ উদ্ধারে সেই নিদর্শনগুলো এড়িয়ে যাই। অদৃশ্যের প্রতিফল এড়িয়ে যায় না। না ফেরার দেশে, আড়ালে, দূরে, বহুদূরে, যেখানেই যাই, উপায়ন্তরের জবাবগুলো এখানেই অর্জনের কথা ছিল। নতুবা সাধক লালন ফকিরের সাধন বাণী গানের কথা মতোই ৮৪ ফের থেকে রেহাই মিলবে না।
কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক ও সম্পাদক পরস্পরে সৃজনশীল কর্ম করছেন। প্রত্যেকেরই মতভেদের পার্থক্য আছে, থাকতেও পারে। আমি আমজনতার কাতারে দাঁড়িয়ে কখনো সংলাপ নকল করি। ‘ভালোবাসা দিবস’ উপলক্ষে আধুনিকায়ন তরুণী দ্বিধাহীন প্রশ্ন ছুড়েছেন। সংলাপপ্রিয়ে বলেছেন, কেন চুমু খেতে পারব না? মতভেদ এমনতর যেন প্রেমিক-প্রেমিকার প্রকাশ্য চুমোতে নিন্দনীয় কিছু নেই। এ কালের কিছু তরুণ-তরুণীর প্রকাশ্য এক অদ্ভুত দাবিও বটে! আমরা নিশ্চয়ই অরাজক কালের ঘূর্ণিপাকে পা রেখেছি। অতীত বাণীর ভবিষ্যতে আজ আমি হাজার বছর পরের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছি। রাজ্যের সভ্যতা বিনাশ পথে; এখানে এসেই তা শুরু হয়েছে। সভ্যহীনতার সকল নমুনা চারদিকে অহরহ মিলছে। প্রযুক্তির মানুষেরাই তা সৃষ্টি করছেন। বিশ্বময় এই মানুষের লক্ষ্য ক্রমশ অগ্রগতিতেই। আমি ভিন্নতায় উৎসাহ কুড়াতে চেয়ে বলেছি, কেন লিখতে পরব না? ভুল-ত্রুটি ও ভাষার মিশ্রণতা আছে তো কি? দুর্বলতায় তো অদ্ভুত বা নিন্দনীয় কিছু নেই। প্রকৃতিগত রহস্যে সবাই অজ্ঞ। মানুষের এই চিরতর অজ্ঞতা ছিল, আছে ও থাকবে। অনেক জানলেও মানুষ রহস্যদাতার দরিয়ায় হাবুডুবু খান, খেতে হয়। সামান্যেই ব্যাকুল আমি চরণাদর্শে অনুকরণীয়। গুরুজনেরা সঠিক পথ দেখালে উপকৃত হব।
আমি একজন না লিখলেও জগতের কোনো ক্ষতি হবে না। ক্ষতি না হয় তাতে কী, ক্ষুদ্র হলেও আমি জগতের বিশেষ অংশ। হাজার চেষ্টাতেও আমাকে এই পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা যাবে না। আমি ও আমার অস্তিত্ব চিরন্তন। এই সত্য বহাল ছিল, আছে ও থাকবে। সৃষ্টিতে মানুষ মানুষের দলিল। মতভেদের বাইরে, এমনকি নিজের অজান্তেও এই মানুষ সৃষ্টি করছেন। কলম ধরছেন, লিখছেন, অন্তে কালিও ফুরাচ্ছেন। মতান্তরে আমিও সৃষ্টি করব। অজ্ঞাত সৃষ্টির অপরাধে বেহিসাবি দায় বহন করব। স্রষ্টার পাশাপাশি গুরুজনদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করব। তবে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাধর মানুষদের স্থায়ী ঠিকানা এখানে নয়। যদি সম্ভব, চল একত্ববোধ প্রভুর সন্তুষ্টে কোরবান হই। আমরা নিরন্তর একই পথের পথিক।
এই পৃথিবীর এত দূর এগোতে তোমাদের মতো গুণীজনের নিবিড় সহযোগিতা আমার পেছনে সর্বদাই ছিল। অদূর ভবিষ্যতেও সেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে না, কোনো দিনই তা ফুরাতে পারে না। অনেক পেয়েছি বলেই আরও পেতে চাই! এতে স্বার্থ উদ্ধারতা থাকে। কিন্তু আমার আমিও নিঃস্বার্থে জন্ম নেইনি। কোথাও না কোথায় সর্বংসহ স্বার্থ বিরাজিত। তোমরা যদি আমার হয়ে আমাকে অগ্রসরের হাত না বাড়াও, সহজ সরল সঠিক পথে সাধুবাদ না জানাও, তাহলে ছন্দহীন ব্যথিত এই কণ্ঠেই আমাকে গাইতে হবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত সেই গান—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে।’
পৃথিবী ভ্রমণে আমি বহুবার গেয়ে বেড়িয়েছি। বিকৃত সেই সুর শোনার মতো কোনো জুড়িদার ছিল না বলেই নিজেকে নিরপরাধ খুঁজে পেয়েছি। ছাত্রজীবনের বন্ধুও প্রিন্স মাহমুদের সুরে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর গানটি এলোমেলো কণ্ঠে গাইতেন। ১৯৯৫ সালের ‘শক্তি’ অ্যালবামের শ্রোতাপ্রিয় সেই গান;
‘যদি তুমি ভালোবাস আমায় এ কারণে পালাতে চাই—
তোমার যোগ্য আমি নই তাই ভয় যদি পেয়েও হারাই পালাতে চাই
তোমার কাছ থেকে আরও দূরে পালাতে চাই
ভাবতে চাই না তোমায় এই সুরে পালাতে চাই…।’
গানের দুরন্ত কথা শুনে বন্ধুকে পুনঃ অনুনয়ে বলতাম, আবার গাইয়ে শোনা। প্রেমিক হিসেবে তুই অতুলনীয়। তোর সঙ্গে কারওই জুড়ি হয় না! পুনঃপুন সেই গান শুনে বলতাম, প্রিয়তমাকে পেয়েও হারানোর বেদনায় আকুতি-মিনতি ও দুর্বলতা প্রকাশে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী জগতের প্রেমিক-প্রেমিকাকে অসাধারণ এক্সপ্রেশন উপহার দিয়েছেন। আমি এই গানের কথায় হৃদয় অভিব্যক্তির অতিরঞ্জন চেষ্টায় বলেছি, প্রিয়তমাকে পেয়েও হারানোর চেয়ে না পাওয়াই ভালো। তবুও কথা থেকে যায়, আমি তোমার যোগ্য নই কেন? আমার মাঝে এমন কি নেই? আমাকে পালাতেই হবে কেন? আমি পালাতে আসিনি, পালাতে পারি না! এই পৃথিবী নিশ্চয়ই পালানোর স্থান নয়। এই পৃথিবী সেই স্থান যেখানে যত বেশি পারো নিজের মেধা ও যোগ্যতায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ কর! যদি সম্ভব, সর্বস্তরের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল কর। আসলে যে যতই দখল করুক, জগৎকরণ মানুষ অপার মহিমার বিন্দুকণাও বুঝে নিতে পারেননি। অজ্ঞতাবশেই বলি, কেবল রাজপ্রসাদের ধনীর দুলালই যদি তোমার যোগ্য হবে তাহলে আমি তোমার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি কেন? তোমার যোগ্য আমি নই, এমনটা হতেই পারে না, কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। আমি সাধারণ কেউ নই, আমি সৃষ্টির সেরা জীব, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এটাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়? আমার অর্থ আভিজাত্য নেই, চাইলেও দিতে পারব না। থাকলেও দিতে সংকোচ বোধ করব না। তুমি আমার না হওয়া বড় বিরহের। আসলেই কঠিন। যদি বুঝতে শিখেছি, তুমি আমার না হওয়াই সবচেয়ে বেশি সহজ। একেবারে পরিষ্কার, তাও স্বচ্ছ কাচের মতো। প্রণয় নির্মমতা বাস্তব, বাস্তব নির্মল সত্য। আজ তুমি ভিন্ন আমিও ভিন্ন, ভিন্ন মোদের বাস। তালাশ করে তোমাকে পাওয়া সম্ভব না। আমার মতোই তোমার আদি অন্ত অপ্রত্যক্ষ! তুমি সৃষ্টিতে নিঃসংশয় আশীর্বাদ; তত্ত্বদর্শীর অভিন্ন সত্তা। আমি অজ্ঞ, পাপী; তোমার মোহে হারিয়ে গেলে নিজেকে আবিষ্কারের শেষ চেষ্টাও করা হবে না। আমি অনাদেয় দায় এড়াতে আবৃত্তি করি—
যদি নাইবা থাক পাশে
তাতে কী যায় আসে?
তুমিহীনা যদি আমি ফাঁকা…!
তবে তুমিও তো রইলে একা।
লাভের আশে প্রেমিক-প্রেমিকা কত কিছুই বলে বেড়ায়। সর্বকালের কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও শিল্পীরাই প্রিয়তমার তাগিদে নিজের সুখ দুঃখ, বিরহ বেদনা ও চাওয়া পাওয়ার মতভেদ কৌশল অবলম্বন করে গেছেন, আজও করছেন। অপার রহস্যের এই খোঁজাখুঁজি বিজ্ঞানের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ সূত্রের চেয়েও বেশি লেগে আছে এই জীবনের মোহে। অথচ তত্ত্বের সামান্য গভীরে ঢুকলে সবই ক্ষণিকের! প্রাচুর্যের ভোগবিলাস, বাড়ি-গাড়ি ও নারী নিতান্তই কিছু না! আমরা কেবল সৌন্দর্যের প্রলুব্ধে দিশেহারা। বস্তুত মানুষের চিত্তেই মানুষের উদয়। তোমাতে আমাতেই নিবৃত্ত আছে পারাপার রহস্যের সাধন ভজনালয়।
হারিয়ে যাওয়া শৈশবসঙ্গী ও বর্তমান প্রজন্মের বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আজ আর চাওয়া পাওয়ার বিশেষ কিছু নেই। তবুও কদাচিৎ সেই বন্ধুরা যখন অনায়াসে ডেকে বলে ও কবি এটা কর, ওটা কর…। ও লেখক এটা নে, ওটা দে…। শুনেই বিস্ময়ে স্নাত হই! অবাকে বলি, এত মিষ্টি মধুর ডাকও জগতে আছে নাকি? যত বড় বিজ্ঞ মনের মানুষ, কবি, সাহিত্যিক বা দার্শনিকই ধরায় এসে ছিলেন তাঁদের কেউতো নেই। আমিও তো থাকব না। জীবনে সবকিছুই পেতে হবে কেন, না পেলেই বা ক্ষতি কী? জগতে কেউইতো পরিপূর্ণ নয়। ইচ্ছে করলেই তো সবকিছু পেয়ে দেখানো সম্ভব না। কিছু অপূর্ণতা জীবন রহস্যের অজ্ঞাত মানে হিসাবে থাকুক না! আমি কবিতা লিখতে পারি না, লেখার ক্ষমতাও রাখি না। কবি হতে হবে এমন দুরাশাও পোষণ করি না। সাহিত্যে হিতাহিত জ্ঞান নেই, জানি না কিছুই। কিছু না জানলেও বন্ধুর ও কবি ও লেখক নামের ডাকে সব পেয়ে গেছি অনুভূত হয়। অনেক অপ্রাপ্তিকে প্রাপ্তির পূর্ণ রূপ দিয়ে দেখা হৃদয় অনুভূতির জন্য সহজ সরল ব্যাপার! হৃদয় সে পারেও বটে! অযথাই ‘ও কবি ও লেখক’ ডাকে ভালো লাগা খুঁজে নেন। কবিকে কবি, লেখককে লেখক ডাকলে ভালো লাগার তেমন কিছু নেই। কেননা, কবি তা প্রত্যাশা করেন। আমার মতো অজ্ঞাতদের সামান্য স্বীকৃতি অস্বীকৃতিতে কল্যাণময় কবির প্রকৃত মূল্যবোধের একটুও হানি ঘটবে না। আমি কবি হওয়ার সান্নিধ্য ক্ষমতা সত্যিই রাখি না, প্রত্যাশাও করি না। সে জন্যেই হয়তো অভিভূত কবির মূল্যবোধ সুখকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। বস্তা ভরে টাকা দিলেও বন্ধুর এই মধুমাখা ডাকের সঙ্গে কিঞ্চিৎ তুলনা হবে না!
মো. জিয়াউদ্দিন শাহ্, জেদ্দা, সৌদি আরব। ইমেইল: <ziauddin_sha@yahoo.com>